আজকে আমরা জানবো, একজন উদ্যোক্তা কাকে বলে? একজন উদ্যোক্তা হলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি একটি নতুন ব্যবসা সৃষ্টি করেন, ব্যবসার ঝুঁকি বহন করেন, এবং ব্যবসা সফল হলে তার সিংহভাগ মুনাফা ভোগ করেন। অর্থাৎ একটি ব্যবসা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগ যিনি গ্রহণ করেন, তিনিই উদ্যোক্তা হিসাবে পরিচিত হন।
উদ্যোক্তারা যেকোন অর্থনীতিতে মূল ভূমিকা পালন করেন। যে কোন দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে ব্যবসা কিংবা উদ্যোগ, যা কিনা উদ্যোক্তাদের মাধ্যমেই আসে। উদ্যোক্তাদের কারণে যেমন দেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পায়, নতুন নতুন পণ্য কিংবা সেবা বাজারে আসে, তেমনি প্রচুর কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়।
অর্থনীতিবিদদের মতে উদ্যোক্তাদের গুরুত্ব
আধুনিক যুগের অর্থনীতিবিদদের মতে, উদ্যোক্তারা যে কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চারটি মূল স্তম্ভের মধ্যে একটি। অন্য তিনটি হল জমি/প্রাকৃতিক সম্পদ, শ্রম এবং মূলধন। একজন উদ্যোক্তা পণ্য তৈরি বা সেবা প্রদানের জন্য এর মধ্যে বাকি তিনটিকে একত্রিত করেন। তারা একটি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করেন, শ্রম নিয়োগ করেন, সম্পদ অর্জন/সৃষ্টি করেন, অর্থায়ন করেন, এবং ব্যবসার জন্য নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনা প্রদান করে থাকেন।
অর্থনীতিবিদরা অবশ্য কখনোই ‘উদ্যোক্তা’র সংজ্ঞায়ন সম্পর্কে একমত হতে পারেন নি। যদিও, উদ্যোক্তার ধারণা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরিচিত ছিল, ক্লাসিকাল এবং নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদরা উদ্যোক্তাদের আনুষ্ঠানিক মডেলের বাইরে রেখেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে অর্থনীতিবিদরা তাদের মডেলগুলিতে উদ্যোক্তাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গুরুত্ব সহকারে চেষ্টা করেছিলেন।
উদ্যোক্তাদের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে তিনজন চিন্তাবিদ ছিলেন মুখ্য: জোসেফ শুম্পেটার, ফ্রাঙ্ক নাইট এবং ইজরায়েল কিরজনার।
শুম্পেটার ধারণা দিয়েছিলেন যে, উদ্যোক্তারা-কেবল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই নয়, বরং মুনাফার সন্ধানে নতুনত্ব তৈরির জন্য কাজ করেন। নাইট ব্যবসায়িক ঝুঁকির বাহক হিসাবে উদ্যোক্তাদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে বাজার ব্যবস্থায় সবথেকে বেশি ঝুঁকি উদ্যোক্তাদেরই বহন করতে হয়। অন্যদিকে, কির্জনার উদ্যোক্তা বলতে বুঝতেন যারা বাজারে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেন, এবং বিদ্যমান সুযোগ গ্রহণ করে নতুন ব্যবসা সূচনা করেন।
উদ্যোক্তারা সাধারণত তাদের কোম্পানি তৈরি করার সময় অনেক বাধার সম্মুখীন হন। তাদের মধ্যে যে তিনটিকে অনেকেই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলো হচ্ছে আমলাতন্ত্রকে কাটিয়ে ওঠা, প্রতিভাবান কর্মী নিয়োগ করা, এবং বিনিয়োগ যোগাড় করা।
চার ধরনের উদ্যোক্তা
সব উদ্যোক্তাই একই ধরনের হয় না। কার্যক্রম, দক্ষতা, কিংবা ব্যবসার ধরনের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোক্তা থাকতে পারে। অনেক সময়ই আমরা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের উদ্যোক্তাদের এক হয়ে একটি নতুন ব্যবসা সৃষ্টি করতে দেখে থাকি। চার ধরনের উদ্যোক্তা সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হয়েছে।
নির্মাতা
‘নির্মাতা’ গোছের উদ্যোক্তারা অল্প সময়ের মধ্যে লাভজনক ব্যবসা তৈরি করতে চান। এই ধরনের উদ্যোক্তারা সেরা প্রতিভা নিয়োগ করে এবং উপযুক্ত বিনিয়োগকারীদের ব্যবসায় নিয়ে আসার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরি করতে চেষ্টা করেন। উল্লেখ্য, নির্মাতা জাতীয় উদ্যোক্তারা তারা যেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করান, সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেই আরও বড় করার চেষ্টা করেন। নাইকির প্রতিষ্ঠাতা ফিল নাইট এ ধরণের উদ্যোক্তাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
সুযোগসন্ধানী
সুযোগসন্ধানী উদ্যোক্তারা সুযোগ বিবেচনা করে সঠিক সময়ে বাজারে তাদের পণ্য কিংবা সার্ভিস নিয়ে আসেন, দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটান, ব্যবসার ভ্যালুয়েশন বৃদ্ধি করে বিনিয়োগ নিয়ে আসেন, এবং যখন একটি ব্যবসা তার শীর্ষে পৌঁছায় তখন প্রস্থান করে থাকেন।
এ ধরনের উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের থেকে উদ্যোক্তার নিজের ব্যক্তিগত প্রবৃদ্ধি প্রাধান্য পায়। ব্যবসার অবস্থা ভালো থাকতে থাকতে এ ধরনের উদ্যোক্তারা নিজের শেয়ার বিক্রি করে দেন, কিংবা মুনাফা তুলে নতুন কোন সুযোগের সন্ধান করেন।
ওয়ারেন ব্রাফেটকে সুযোগসন্ধানী উদ্যোক্তার কাতারে ফেলা যায়।
উদ্ভাবক
উদ্ভাবক হচ্ছেন সেই ধরনের উদ্যোক্তা, যারা একটি দুর্দান্ত ধারণা বা পণ্য নিয়ে আসেন যা আগে কেউ ভাবেনি। টমাস এডিসন, স্টিভ জবস এবং মার্ক জুকারবার্গ এ ধরনের উদ্যোক্তার । এই ব্যক্তিরা তাদের পছন্দের বিষয়ে কাজ করেন এবং তাদের দূরদৃষ্টি ও দক্ষতার মাধ্যমে ব্যবসার সুযোগ খুঁজে পান। উল্লেখ্য, বাজারের চাহিদা বুঝে ব্যবসা দাঁড় করানোর বদলে, উদ্ভাবকেরা নিজেরাই চাহিদা তৈরি করেন।
অর্থের উপর গুরুত্ব প্রদান করার পরিবর্তে, উদ্ভাবকরা সমাজে তাদের পণ্য এবং পরিষেবাগুলির প্রভাব সম্পর্কে বেশি যত্নশীল। এই উদ্যোক্তারা ব্যবসা চালানোর ক্ষেত্রে অনেক সময়ই নিজের সেরাটা দিতে পারেন না, কারণ তারা আইডিয়া তৈরি করেন, তা বিক্রি করার দক্ষতা তাদের সবসময় থাকে না।
বিশেষজ্ঞ
এই ধরণের উদ্যোক্তারা সবথেকে ভালো ঝুঁকি সামাল দিয়ে থাকেন। তারা নির্দিষ্ট কোন একটি ইন্ডাস্ট্রিতে দক্ষতা অর্জন করেন, এরপর সেই দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে নিজের ব্যবসা চালু করেন। মোটের ওপর, এ ধরনের উদ্যোক্তাদের সংখ্যাই আমরা সবথেকে বেশি দেখে থাকি। ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য এ ধরনের উদ্যোক্তারা নেটওয়ার্কিং এর সাহায্য নিয়ে থাকেন।
উদ্যোক্তা হবেন যেভাবে
প্রথাগত পেশার বিপরীতে, উদ্যোক্তার রাস্তাটি বেশিরভাগের কাছে বেশ দুর্বোধ্য। একজন উদ্যোক্তার জন্য যা কাজ করে, তা আরেকজনের জন্য কাজ নাও করতে পারে। যাই হোক, মোটের ওপর সাতটি ধাপ রয়েছে যা কমবেশি সব উদ্যোক্তাদের জন্যই কাজে লেগে থাকে (কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া)।
আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করুন
এই প্রথম পদক্ষেপ একটি অবশ্য প্রয়োজনীয়তা নয়, আর্থিক স্থিতিশীলতা ব্যবসায় সাফল্যের সম্ভাবনা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। আর্থিক স্থিতি ছাড়া অনেক উদ্যোক্তারা সফল ব্যবসা গড়ে তুলেছেন, তবে স্থিতিশীল আর্থিক অবস্থা দিয়ে শুরু করা একটি মজবুত ব্যবসার ভিত্তি।
আর্থিক স্থিতি একজন উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত তারল্য বাড়ায় এবং অর্থ সংগ্রহ চালিয়ে যাওয়া বা স্বল্পমেয়াদী ঋণ ফেরত দেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করার বদলে একটি সফল ব্যবসা তৈরিতে কাজ করার জন্য তাদের আরও সময় দেয়।
একটি বৈচিত্র্যময় দক্ষতার গুচ্ছ তৈরি করুন
একবার একজন উদ্যোক্তার শক্তিশালী অর্থায়ন হয়ে গেলে, বিভিন্ন দক্ষতা তৈরি করা এবং তারপর সেই দক্ষতাগুলি বাস্তব জগতে প্রয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় ধাপের সৌন্দর্য হল এটি ধাপে ধাপে করা যায়।
নতুন কাজ শেখার এবং তা প্রয়োগের চেষ্টা করার মাধ্যমে একটি দক্ষতা গুচ্ছ তৈরি করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোক্তার অর্থের ভিত্তি থাকে, তাহলে তারা সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সফট স্কিল শিখতে তাদের বিদ্যমান কোম্পানিতে বিভিন্ন রোলে কাজ করতে পারেন। একটি বৈচিত্র্যময় দক্ষতা গুচ্ছ তৈরি হয়ে গেলে, এটি একজন উদ্যোক্তাকে কঠিন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে।
যদিও একটি সফল ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য একাডেমিক ডিগ্রি জরুরি নয়, তবে এটি তরুণ উদ্যোক্তাদের অন্যান্য অনেক উপায়ে বিশ্ব সম্পর্কে অনেক কিছু শেখাতে পারে। তাই একাডেমিক দক্ষতাও অর্জন করা উচিত একজন উদ্যোক্তা হতে গেলে।
সমাধান করার জন্য একটি সমস্যা চিহ্নিত করুন
একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোক্তা সমাধানের জন্য বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করতে সক্ষম হন। একটি কোম্পানির পণ্য বা পরিষেবার একটি নির্দিষ্ট পেইন পয়েন্ট সমাধান করতে হয়, অন্য ব্যবসার জন্য বা একটি ভোক্তা গোষ্ঠীর জন্য। একটি সমস্যা চিহ্নিত করার মাধ্যমে, একজন উদ্যোক্তা সেই সমস্যা সমাধানের জন্য একটি ব্যবসা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।
বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে রিসার্চ করে সমাধানের জন্য বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করা সম্ভব। এটি প্রায়শই একজন উদ্যোক্তাকে এমন একটি সমস্যা দেখার ক্ষমতা প্রদান করে, যা অন্যের চোখে ধরা পরে না।
সেই সমস্যার সমাধান করুন
সফল স্টার্টআপ অন্যান্য কোম্পানি বা জনসাধারণের জন্য একটি নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধান করে। শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধান করার মাধ্যমেই একজন উদ্যোক্তা সফল হতে পারেন।
বলুন, উদাহরণস্বরূপ, আপনি শনাক্ত করেছেন যে ডেন্টাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট করার প্রক্রিয়াটি রোগীদের জন্য জটিল, এবং ফলস্বরূপ ডেন্টিস্টরা গ্রাহক হারাচ্ছেন। আপনি একটি অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিস্টেম তৈরি করতে পারেন যা অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করা সহজ করে তোলে।
নেটওয়ার্কিং করুন
যে কোন ব্যবসা সফল করার অন্যতম প্রধাণ অনুষঙ্গ হচ্ছে নেটওয়ার্কিং করা। যখন আপনি আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করবেন, সাথে সাথেই আপনার ব্যবসা সম্পর্কে সবাই জেনে যাবে না। ব্যবসার প্রসার এবং প্রচারের দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। এক্ষেত্রে সঠিক নেটওয়ার্কিং হতে পারে খুবী কার্যকরী।
কনফারেন্সে যোগদান করা, ইন্ডাস্ট্রির লোকেদের ইমেল করা এবং কল করা, একই ব্যবসায় আছে এমন লোকেদের সাথে আড্ডা দেয়া, ইত্যাদির মাধ্যমে আপনি আপনার ব্যবসার নেটওয়ার্ক দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারবেন । একবার আপনি সঠিক লোকেদের দরজায় পা রাখলে, একটি ব্যবসা পরিচালনা করা সহজ হয়ে যায়।
সফল উদ্যোক্তা হতে হলে নিজের ব্যবসার ওপর বিশ্বাস রাখুন, ধৈর্য ধরুন, এবং নিজের স্কিল উন্নত করুন। উদ্যোক্তারা বাজারে প্রবেশ করেন, কারণ তারা নিজেদের কাজটি পছন্দ করেন, এবং বিশ্বাস করেন সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে তাদের পণ্যের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।